দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর মতো স্বাস্থ্য খাতও দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। রাজনৈতিক বিভাজন ও পক্ষপাতিত্ব দীর্ঘদিন ধরে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসা শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) স্বাস্থ্যখাতে একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল। এ সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, মেডিকেল কলেজ ও সরকারি হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় স্বাচিপের প্রভাব ছিল স্পষ্ট।
অপরদিকে, বিএনপি–সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), জামায়াত–সমর্থিত ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ) এবং রাজনীতির বাইরে থাকা চিকিৎসকেরা দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে নতুন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতাল পরিচালকদের মধ্য থেকে স্বাচিপ–সমর্থিতদের অনেককেই সরিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) নিবন্ধিত চিকিৎসক আছেন প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার। এর মধ্যে সরকারি চাকরিতে আছেন ৩৪ হাজারের মতো।
সূত্র জানায়, স্বাচিপের সদস্য প্রায় ১৩ হাজার, যাদের প্রায় ৪০ শতাংশ সরকারি চাকরিতে রয়েছেন।
হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের স্থবিরতা দূর করতে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসককে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিদ্যমান পদসংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক পদে পদোন্নতিই সুপারনিউমারারি পদোন্নতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৮২টি বিষয়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসকের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক পদোন্নতির নজির দেশে আগে ছিল না।’
গত ২২ অক্টোবর গাইনিকোলজি ও অবস্ বিষয়ে ৫৯৯ জন চিকিৎসককে সুপারনিউমারি সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এক দিন পর নতুন প্রজ্ঞাপনে সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করা হয়। যার কারণ ব্যাখ্যা করেনি মন্ত্রণালয়।
পদন্নোতি বঞ্চিত এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈশাখী অনলাইনকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের ফিট লিস্ট দেখে প্রমোশন দেয়ার কথা। প্রথম দফায় লিস্টে দেয়া হয়েছিল ৫৯৯ জনকে। চাকরি বিধিমালার সমস্ত শর্ত পূরণ করে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে ৯৩০ জনকে সুপারনিউমারি পোস্ট ক্রিয়েশন করা হয়েছিল। প্রথম দফায় লিস্টে দেয়া হয়েছে ৫৯৯ জনকে। পরবর্তীতে তা থেকে সাত জনকে বাদ দিয়ে ৫৯২ জন করা হয়েছে। পোস্ট খালি আছে ৩৩৮টি। বাদ দেয়া হইছে ২৮২ জনকে। ১০/১২ জনের কিছু কাগজজনিত সমস্যা ছাড়া বাকি সবাইকে স্বাচিপ তকমা দিয়ে বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওই চিকিৎসক।
তিনি আরও বলেন, ৫৯২ জনের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা স্বাচিপের লাইফ মেম্বার। তাহলে তারা কিভাবে প্রমোশন পেয়েছে এমন অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে স্বাচিপের লাইফ মেম্বার থেকে যেসব চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়েছেন সে তালিকাও বৈশাখী অনলাইনের হাতে এসেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, ‘যাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে তারা শুধু কাগজে কলমেই লাইফ মেম্বার, অধিকাংশকেই লাইফ মেম্বার হতে বাধ্য করা হয়েছে গ্রামগঞ্জে ট্রেনিংয়ের সময়, তারা কখনো বেনিফিশিয়ারি ছিল না। ১৪ বছর কোনো প্রমোশন হয়নি, আওয়ামী লীগের কোনো মিছিল মিটিংয়ে যায়নি। এমনকি স্বাধীনতার চিকিৎসক পরিষদের কোনো প্রোগ্রামেও এটেন্ড করেনি বা তাদের কোনো পলিটিক্যাল পোস্টেও ছিল না শুধু কাগজেই লাইফ মেম্বার। অথচ যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পোস্টে ছিল তারা আজ প্রমোশন পেয়েছে।’
পদোন্নতি বাতিল হওয়া অন্য এক চিকিৎসক বৈশাখী অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে কাজ করেছি, সব যোগ্যতাও ছিল। হঠাৎ পদোন্নতি বাতিল করা অন্যায়।’
তবে স্বাস্থ্য সচিব মো. সাঈদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওই সাতজনকে ভুল করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।’
স্বাচিপ–সমর্থিত চিকিৎসকেরা দাবি করেছেন, নতুন সরকার আসার পর তাদের অনেককে অযৌক্তিকভাবে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ড্যাব ও এনডিএফ–এর সদস্যদের পদোন্নতি নির্বিঘ্নে হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
তবে ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো তালিকা দেইনি বা কারও পদোন্নতিতে বাধা দেইনি। একসঙ্গে এত পদোন্নতি হচ্ছে, কিছু ভুল হলে মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই তা সংশোধন করবে।’
মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতির তালিকা তৈরিতে চিকিৎসক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সোসাইটি—যেমন মেডিসিন সোসাইটি, ওজিএসবি—সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে পদোন্নতি দেওয়া বা বঞ্চিত করা স্বাস্থ্য খাতের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন অনেক চিকিৎসক। তাদের মতে, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সেবার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।












